অর্থবছর গণনায় পরিবেশ ও উন্নয়নমবিমুখ পাকিস্তানি ধারা!

আজাদুর রহমান চন্দন
প্রতিবছর ঘটা করে পয়লা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করি আমরা। কিন্তু পয়লা বৈশাখ কী শুধুই উৎসবের বিষয়, সংস্কৃতির বিষয়? বাংলার তথা এ অঞ্চলের অর্থনীতির সঙ্গে এর সম্পর্কের বিষয়টি কি আমরা ভুলেই থাকব? উন্নয়ন নীতিমালায় প্রকৃতি ও পরিবেশ যে মোটেই গুরুত্ব পায়নি তার বড় নজির আমাদের দেশের অর্থবছরের হিসাবটি। এক বর্ষায় (জুলাই মাস) অর্থবছর শুরু হয়ে আরেক বর্ষায় (জুন) তা শেষ হয়। উন্নয়ন প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটি বড় বাধা।
২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে এক নির্দেশনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি বছর বর্ষায় অর্থবছর শুরু হয় বলে ওই সময় অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজগুলো করা সম্ভব হয় না। তবে প্রকল্পের নথিপত্রের কাজগুলো ওই সময়ের মধ্যে শেষ করে ফেলার জন্য সচিবদের নির্দেশ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাগজপত্রের কাজ শেষে শুকনো মৌসুমে অবকাঠামোগত কাজগুলো করতে হবে। এতে অর্থের অপচয় বন্ধ এবং জনগণের উপকার হবে।
প্রধানমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ধরতে পেরেছেন, সেজন্য তাকে অভিনন্দন। তবে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের যে পথ তিনি দেখিয়েছেন তা তেমন কাজে আসবে বলে মনে হয় না। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হলো অর্থবছর গণনার ধারাটা পাল্টে ফেলা। এ দেশে অর্থবছরের হিসাবটা অবশ্য বরাবর এ রকম ছিল না।
বাংলা সনের প্রবর্তন কবে হয়েছিল, কে তার প্রবর্তক, তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক আছে। তবে বেশির ভাগ মানুষেরই মত, মোগল সম্রাট আকবর এর প্রবর্তক। তিনি ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে, হিজরি ৯৬৩ সালে ‘তরিক-ই-ইলাহি’ নামের নতুন সনের প্রবর্তন করেছিলেন দিল্লিতে। তখন থেকেই আঞ্চলিক পর্যায়ে বাংলা সনের গণনা শুরু হয়েছিল। তবে রাজা শশাঙ্ক, সুলতান হোসেন শাহ ও তিব্বতের রাজ স্রংসনকেও বাংলা সনের প্রবর্তক বলে মনে করেন কেউ কেউ। ‘সন’ শব্দটি আরবি এবং ‘সাল’ শব্দটি ফারসি। এই শব্দ দুটির কারণে বাংলা সন বা সাল মুসলিম শাসকদেরই প্রবর্তিত বলে পণ্ডিতেরা মনে করেছেন। বৈদিক যুগে অঘ্রানকে বছরের প্রথম মাস বলে গণ্য করা হতো। তবে এই অঞ্চলের চাষাবাদের সঙ্গে মিলিয়ে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ফসলি সন হিসেবে বৈশাখকেই বছরের প্রথম মাস ধরে বাংলা সনের গণনা শুরু হয়েছিল। সুবাদার মুর্শিদ কুলি খানের সময়ে বৈশাখ মাসের শুরুতে খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে পয়লা বৈশাখে এক ধরনের আর্থসামাজিক আনন্দ-উৎসবের সূচনা হয়েছিল বলে গবেষকেরা মনে করেন।
আমাদের দেশে বাজেট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় প্রতিটি অর্থবছরকে চারটি কোয়ার্টারে ভাগ করে। প্রথম কোয়ার্টারে (জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) বন্যায় বিপর্যস্ত থাকে গোটা দেশ। অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মিলে দ্বিতীয় কোয়ার্টারে হয় শীতের আগমন। তৃতীয় কোয়ার্টার (জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ) বিদায় নেয় শীত। চতুর্থ কোয়ার্টারে (এপ্রিল, মে ও জুন) দেখা দেয় আগাম বন্যার বিপর্যয়। অক্টোবর-নভেম্বর সাইক্লোনের মাস, এপ্রিল-মে কালবৈশাখী ও আগাম বন্যার মাস। অতএব উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রকৃত কাজের সময় পাওয়া যায় ডিসেম্বর থেকে মার্চ; দেড় কোয়ার্টার মাত্র। জুনের মধ্যেই উন্নয়ন প্রকল্প শেষ করার তাগিদ থাকে। তাই বর্ষার শুরুতে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করতে হয়। সরকারের বর্তমান পরিকল্পনা এমন যে, তাতে শেষ কোয়ার্টারের দুর্যোগের জন্য বিশেষ বিবেচনা থাকে না। দুষ্টচক্র এরই সুযোগ নেয়। তারা সামান্য কিছুতেই খারাপ আবহাওয়ার অজুহাত দিয়ে কাজ খারাপ করে। এ অজুহাতে তারা প্রকল্পটি ত্রুটিপূর্ণভাবে বুঝিয়ে দেয় অথবা সরকারকে বেকায়দায় ফেলে সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে নেয়।
পাকিস্তানে বর্ষা শুরু হয় জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে (শ্রাবণ ও ভাদ্র তাদের বর্ষাকাল)। অতএব ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন অর্থবছর হওয়া তাদের জন্য বরং সুবিধাজনক। ভারত তাদের ব্যয় ব্যবস্থায় ঋতু অনুযায়ী ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত অর্থবছর পালন করে। বাংলাদেশ সরকারের ব্যয় যে চারটি কোয়ার্টারে হিসাব ও তা সমাপ্ত করা হয়, তার শেষ কোয়ার্টারে আসে বৃষ্টি ও বন্যা। আর বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এই শেষ কোয়ার্টারেই সবচেয়ে বেশি দেখানো হয়।
পাকিস্তান ছাড়া এ অঞ্চলের খুব কম দেশেই জুলাই থেকে অর্থবছর গণনা করা হয়। আমাদের প্রতিবেশী ভারত ছাড়াও মিয়ানমারে অর্থবছর শুরু হয় ১ এপ্রিল। হংকং, জাপান ও সিঙ্গাপুরেও তাই। এপ্রিল কিংবা বৈশাখ থেকে অর্থবছর শুরু করাটা আমাদের দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানানসই হবে। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, চীন ও তাইওয়ানে অর্থবছর শুরু হয় ১ জানুয়ারি। যুক্তরাজ্যে শুরু হয় ৬ এপ্রিল। যুক্তরাষ্ট্রে ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় অর্থবছর। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতা লাভের চার দশক পরও অর্থবছর গণনার ক্ষেত্রে আমরা পাকিস্তানি ধারায়ই রয়ে গেলাম।

About

AZADUR RAHMAN CHANDAN E-mail : archandan64@gmail.com Date of Birth : November 27, 1964 Profession : Journalist (Working at The Daily Kaler Kantho) Academic Qualification : BScAg (Hons) from Bangladesh Agricultural University Institute : Patuakhali Agricultural College

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *