কলঙ্ক মোচনের বিচারপথে এখনো কিছু কালো ছায়া

আজাদুর রহমান চন্দন

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি একাত্তরের নরঘাতকদের বিচার দেখার প্রতীক্ষায় কাটিয়েছে চার দশকেরও বেশি সময়। নানা অনিশ্চয়তা, হতাশা আর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর অবশেষে সেই প্রতীক্ষার অবসান শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে জাতির কলঙ্ক মোচন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রথম ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বাংলাদেশের ৪৩তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে। সেদিন রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় কসাই কাদের নামে পরিচিত আলবদর কমান্ডার আবদুল কাদের মোল্লাকে। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর এই নেতার ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এর মাধ্যমে একাত্তরের নির্মমতার বিচারহীনতা থেকে মুক্তি পেতে শুরু করে জাতি। অনেক দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা, গাফিলতি, চক্রান্ত সত্ত্বেও চলমান রয়েছে সেই বিচারকাজ। এরইমধ্যে গত ১১ এপ্রিল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘাতক আলবদর বাহিনীর বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রধান সংগঠক মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের, যিনি যুদ্ধের শেষ দিকে আলবদর হাইকান্ডেও ঠাঁই পেয়েছিলেন। কুখ্যাত সেই বদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মুজাহিদের প্রাণদণ্ড বহাল আছে আপিলের রায়ে। এখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপক্ষায়। এসবই জাতির জন্য সুখবর। তবে চার দশকের কলঙ্ক মোচনের এই বিচার চলাকালে সময়ে সময়ে জাতির কাঁধে ভর করেছে ভয় আর হতাশা।
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় ৪৩তম বিজয় দিবসে দেশবাসী যতটা না উল্লসিত ও উজ্জীবিত ছিল, ৪৪তম বিজয় দিবসে ততটা দেখা যায়নি। জনমনে সবচেয়ে বেশি সংশয় এখন অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার নিয়ে। আইনের অস্পষ্টতা দূর করার নামে এ ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে কোনো কোনো মহলের অভিযোগ। আবার কাদের মোল্ল­ার ফাঁসির দাবিতে জন্ম নেওয়া যে গণজাগরণ মঞ্চে গর্জে ওঠেছিল ‘আরেক একাত্তর’, সেই মঞ্চে ভাঙন ধরানোটাও অশুভ লক্ষণ বলে মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। এ ছাড়া শাসক দলের কোনো ত্রুটি কিংবা শাসনব্যবস্থার কোনো গলদের ফাঁক গলে আবার স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলীয়ান হয়ে ওঠে কি না, সেই সংশয়ও আছে।
সবারই জানা, একাত্তরের ঘাতকদের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়েছিল, যদিও পরে দেশটি তার অবস্থান কিছুটা বদল করেছে। এখন ব্যক্তিবিশেষের বদলে জামায়াতকে বাঁচাতে তৎপর তারা। যুদ্ধাপরাধবিষয়ক মার্কিন দূত স্টিফেন জে র‌্যাপ গত বছর আগস্টে তাঁর সর্বশেষ ঢাকা সফরকালে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘সামাজিক পুনর্মিলনের স্বার্থে’ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কোনো সংগঠনের বিচার হওয়া উচিত নয়। বহির্বিশ্বের এ ধরনের অবস্থানের কারণেই সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের লক্ষ্যে আইন সংশোধনে কালপেণ করা হচ্ছে, নাকি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কোনো সমীকরণ এতে কাজ করছে, সে নিয়েও আছে নানা সংশয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধসহ বিভিন্ন অভিযোগে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের লক্ষ্যে এক বছর আগেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিল হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা মিলিয়ে যায় দ্রুতই। গত বছরের ১৪ মে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী দল বা প্রসিকিউশনের দায়িত্বশীল সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘এ মাসের শেষ সপ্তাহে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হতে পারে।’ জাতির জন্য এটি একটি সুসংবাদই ছিল বটে। কিন্তু ওই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সপ্তাহ না পেরুতেই একটি দুঃসংবাদ জাতিকে হতাশায় ডুবিয়ে দিতে বসে। প্রসিকিউশন বা রাষ্ট্রপক্ষের যে আইনজীবীদলটি জামায়াতের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ তৈরির কাজ করছিল, তারা সেই কাজ বন্ধ করে দিয়েছে প্রসিকিউশনেরই একাংশের হস্তক্ষেপে। এ নিয়ে শুরু হয় দুই পক্ষের বাদানুবাদ। অন্যদিকে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানিয়ে দেন, অপরাধী সংগঠনের শাস্তি কী হবে, তা আইনে স্পষ্ট না করে জামায়াতের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হবে না। মন্ত্রী হওয়ার পর গত বছর মার্চেও আনিসুল হক ল রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে আদালত অবমাননা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আইনে দণ্ডের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট না থাকলে বিচারক কাউকে দণ্ড দিতে পারেন না। তবে তিরস্কার করতে পারেন।’ মন্ত্রী হওয়ার আগেও তিনি এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বিচারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধী সংগঠনের শাস্তি কী হবে–এ বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। এ ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হতে পারে।’ ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় তাঁর ওই বক্তব্য ছাপা হয়েছিল। ঘনিষ্ঠ অনেকের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমি নিজেও জমায়াতের বিচার শুরু করার আগেই আইনে অপরাধী সংগঠনের শাস্তি সুনির্দিষ্ট করার পক্ষে লিখেছি পত্রিকায়। তাই বলে আইনের সামান্য সংশোধনী আনার নামে এত সময়ক্ষেপণ সমর্থনযোগ্য নয়। সঙ্গত কারণেই এ বিষয়টির মধ্যেও রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুানলস) করা হয়েছিল। তবে ওই সময় আইনটি কাজে লাগানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যদিও দালাল আইনে কিছু লোকের বিচার হয়েছিল এবং আরো অনেকের বিচার চলছিল; কিন্তু পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ওই আইন বাতিল করে সাজাপ্রাপ্ত ও কারাবন্দি দালালদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। এর কয়েক দিন পরই কারাগারের ভেতরে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকেও। ৩০ লাখ শহীদ আর চার লাখের বেশি মা-বোনের লাঞ্ছনার বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন স্বদেশ উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছিল মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরলেও সেই মেয়াদে একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের উদ্যোগই নেয়নি। বরং ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলন অনেক সমালোচনার জন্ম দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেকেই হতাশ হয় এতে। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিজয় এবং একত্রে সরকার গঠনের পর আবার অন্ধকারের দিকে পথচলা শুরু হয়। নির্বাচনের পরপরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর ব্যাপক হামলা-নির্যাতন-ধর্ষণ। মন্ত্রিত্বের সুবাদে গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন আলবদরপ্রধান মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক রায়েও ওই ঘটনাকে জাতির জন্য লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করা হয়েছে। নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিকে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী করা ছিল একটি বড় ভুল। এটি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ মা-বোনের গালে কষে চড় দেওয়ার শামিল।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচারের অঙ্গীকারসহ দিনবদলের সনদ ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে। ফলে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী মহাজোট সরকার ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে পরিচিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ায় চার দশক পর জাতি নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথম ৯ মাসে একটি অভিযোগও গঠিত না হওয়ায় জনমনে সংশয় দানা বাঁধে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রায় চার মাস পর ২০১০ সালের ১৫ জুলাই এর কার্যপ্রণালি বিধি প্রকাশ করা হয় প্রজ্ঞাপন আকারে। ওই কার্যপ্রণালি বিধি না থাকায় ট্রাইব্যুনাল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন তাঁদের কর্মপরিধি ও পদ্ধতি নিয়ে ছিলেন অন্ধকারে। ফলে কার্যক্রম চলে এলোমেলোভাবে। আবার দেরিতে কার্যবিধি তৈরি হলেও অনেক বিষয় তাতেও অস্পষ্ট থেকে যায়। অবশেষে সেই বছরের ২৮ অক্টোবর সংশোধিত কার্যবিধি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। শুরুতেই সবচেয়ে বেশি সংশয় দেখা দেয় তদন্ত সংস্থার ‘প্রধান’ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিয়ে। তাঁকে সরাতেও লেগে যায় অনেকখানি সময়।
ট্রাইব্যুনাল ২০১০ সালের ২৮ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে পুরনো হাইকোর্ট ভবনে। শুরুতে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের অফিসও ছিল সেখানেই। কিন্তু ওই ভবনে স্থান সংকুলান না হওয়ায় সে বছরের ৪ জুলাই বেইলি রোডে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের জন্য নতুন কার্যালয় স্থাপন করা হয়। সেখানেও দুটি সংস্থার কাজ করা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে প্রসিকিউশনের কার্যালয় সরিয়ে নেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের পাশে একটি ভবনে। কিন্তু প্রসিকিউটরদের কেউ কেউ এতে নাখোশ হন। তদন্তের কাজে সহায়তার জন্য গবেষকরা যেসব দলিলপত্র সরবরাহ করেছিলেন, সেগুলো ছিল বেইলি রোডের কার্যালয়ে একটি কক্ষে। তদন্ত সংস্থা দীর্ঘদিন সেই কক্ষটি খুলতে পারছিল না চাবি তাদের হাতে না থাকায়। একজন প্রসিকিউটর চাবিটি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। এ জটিলতা কাটতেও অনেক দিন লেগে যায়। দীর্ঘদিন পর তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ও সরিয়ে নেওয়া হয় ধানমণ্ডিতে।
তদন্ত সংস্থার কো-অর্ডিনেটর মনোনীত করার আগে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংস্থায় সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ে। সমন্বয়ের অভাব লক্ষ্য করা যায় প্রসিকিউটরদের মধ্যেও। প্রসিকিউটরদের অনেককেই পেশাগত কাজে যতটুকু ব্যস্ত দেখা যায়, ট্রাইব্যুনালের কাজে তেমনটা দেখা যায়নি। একটি সুসংগঠিত একক টিম হিসেবে প্রসিকিউশনের সক্রিয়তা চোখে পড়েনি দীর্ঘদিন। এ ছাড়া গঠন করা হয়নি কোনো গবেষণা সেল। অথচ এ ধরনের বিচারের ক্ষেত্রে এটি ছিল অপরিহার্য। এই বিচার প্রক্রিয়ায় তদন্তকারী ও প্রসিকিউটরদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা দরকার ছিল সংশ্লিষ্ট গবেষকদেরও। সে রকম কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। যদিও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে গবেষকদের কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে নানা তথ্য ও দলিল তদন্ত সংস্থা কিংবা প্রসিকিউশনকে দিয়েছেন। কিন্তু একজন প্রসিকিউটর এ-সংক্রান্ত বেশ কিছু পেপারের ওপরে সংশ্লিষ্ট গবেষকের নাম-পরিচয় বাদ দিয়ে নিজের নামের লেবেল লাগিয়ে যাদের দেখালে ব্যক্তিগত লাভ হবে, তাদের শুধু দেখিয়েছেন, সেগুলো ভালো করে পড়ে দেখারও তাগিদ বোধ করেননি।
এ বিচার নিয়ে জনমনে শুরু থেকে যে সংশয় ছিল তা পরে আরো ঘনীভুত হয় যখন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষস্থানীয় চার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা ফরমাল চার্জ ‘সুবিন্যস্ত’ না হওয়ায় ফেরত দেয় ট্রাইব্যুনাল। অথচ গোলাম আযমের ফরমাল চার্জ কীভাবে সুবিন্যস্ত করে লিখতে হবে তা মৌখিকভাবে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি লিখিত রূপরেখাও দেওয়া হয়েছিল একাধিক প্রসিকিউটরকে। কিন্তু তারা তা আমলে নেননি। পরে ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় মানুষের সংশয় বিক্ষোভে রূপ নেয়। কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। রায় শোনার জন্য সেদিন ট্রাইব্যুনালের সামনে ভিড় জমিয়েছিল নানা স্তরের মানুষ। কিন্তু রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাৎক্ষণিকভাবেই হতাশা ব্যক্ত করেন। মর্মস্পর্শী সব হতাশাধ্বনির পাশাপাশি সারা দেশে সর্বস্তরের মানুষের কণ্ঠেও উচ্চারিত হয়, ‘এ রায় মানি না।’ ক্ষোভে-দুঃখে মানুষ নেমে আসে রাজপথে। সবার কণ্ঠে একই দাবি, ‘কাদের মোল্ল­ার ফাঁসি চাই।’ একপর্যায়ে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এর পর থেকেই গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা হয়ে আছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কাদের মোল্ল­ার সাজা বাড়িয়ে ফাঁসির আদেশ দেয় ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংক্ষিপ্ত এক রায়ে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল যাতে এ বিচারপ্রক্রিয়ায় সরকারের দিক থেকে কোনো গাফিলতি না করা হয়। কোনো রকম ত্রুটি-দুর্বলতা বা রাজনৈতিক লাভ-লোকসানজনিত হিসাবের মারপ্যাঁচে যাতে বিচারপ্রক্রিয়াটি হোঁচট না খায় বা ব্যর্থ না হয় সে জন্য সারাক্ষণ সতর্ক নজর রেখেছে তারা। অনেকে যেচে তথ্য-উপাত্ত ও দলিলপত্র দিয়ে সহায়তা করেছে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনকে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব সহায়তা সব সময় সঠিকভাবে কাজে লাগাননি সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউটররা। কোনো কোনো প্রসিকিউটর অন্যের কাছ থেকে গবেষণাপত্রসহ বিভিন্ন দলিল নিয়ে সেসবের লেবেল পাল্টে গবেষক হিসেবে নিজের নাম লাগিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের দেখিয়ে স্বীয় স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেছেন।
অন্যদিকে একাত্তরের চিহ্নিত অপরাধী ও তাদের মিত্ররা শুরু থেকে চেষ্টা করে আসছে বিচার বানচাল করার জন্য। তারা দেশে-বিদেশে ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়েছে। এ জন্য শত শত কোটি টাকা দিয়ে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। চক্রান্তের জাল বুনেছে ভেতরে বাইরে। ট্রাইব্যুনাল ও বিচারপ্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করার উদ্দেশ্যে রায়ের খসড়া ফাঁস করার ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা। এসব করেও বিচার ঠেকানো যাবে না দেখে একপর্যায়ে তারা বেছে নেয় নাশকতা ও সহিংসতার পথ। গুজব রটিয়ে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তাদেরও সহিংস কর্মকাণ্ডে নামিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী ওই ধর্মব্যবসায়ীরা। কিন্তু কোনো কিছুতেই শেষরক্ষা হয়নি তাদের।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী গড়ার হোতা এবং গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নকশাকার গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও সর্বোচ্চ শাস্তি না দিয়ে তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ায় অনেকেই সমালোচনামুখর হয়। এমন অপরাধীকে অনুকম্পা দেখানোর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। ফৌজদারি অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে অপরাধীর বয়স বিবেচনা করার নজির বিভিন্ন দেশে আছে। বাংলাদেশেও অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে তার বয়স বিবেচনা করার বিষয়টি আইনে না থাকলেও সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় আছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে অপরাধীর বয়স বিবেচনায় নেওয়ার নজির কোনো দেশেই তেমন মেলে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অধীকৃত পোল্যান্ডে নাৎসি বাহিনীর একটি একসটারমিনেশন ক্যাম্পের গার্ড (রক্ষী) ছিলেন ইউক্রেনিয়ান বংশোদ্ভূত জন দেমিয়ানিউক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১১ সালে জার্মানির একটি আদালত যখন দেমিয়ানিউককে মৃত্যুদণ্ড দেয় তখন তার বয়স ছিল ৯১ বছর। এর আগে ইসরায়েলের একটি আদালত তাকে শাস্তি দিলেও নাম বিভ্রাটের কারণে আপিলে তিনি পার পেয়ে যান। স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্রের প্রথম বিচারবিষয়কমন্ত্রী আন্দ্রিইয়া আরতুকভিচকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ১৯৮৬ সালে, যখন তার বয়স ছিল ৮৭ বছর। শুধু তা-ই নয়, আরতুকভিচের স্বাস্থ্য তখন এতটাই খারাপ ছিল যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও, তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে ১৯৮৮ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি কারা হাসপাতালে মারা যান।
আমাদের সামনে এমন সব নজির যেখানে রয়েছে, সে ক্ষেত্রে গোলাম আযমের বিচারের রায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আপিলের রায়ে সাঈদীর সাজা কমে যাওয়ার ঘটনায়ও হতাশা ব্যক্ত করেছে অনেকে। সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের উদ্যোগ আদৌ নেওয়া হবে কি না সে সংশয়ও দানা বাঁধছে আইন সংশোধনের নামে কালপেণের কারণে।

About

AZADUR RAHMAN CHANDAN E-mail : archandan64@gmail.com Date of Birth : November 27, 1964 Profession : Journalist (Working at The Daily Kaler Kantho) Academic Qualification : BScAg (Hons) from Bangladesh Agricultural University Institute : Patuakhali Agricultural College

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *