দূষণে বাড়ছে বজ্রপাত, বাড়ছে প্রাণহানি

আজাদুর রহমান চন্দন

এখন থেকে ১৫-২০ বছর আগেও বজ্রপাত মানুষের কাছে তেমন আতঙ্কের বিষয় ছিল না। আমাদের দেশে কয়েক থানা এলাকা ঘুরে হয়তোবা বজ্রপাতে ওপরের অংশ পুড়ে যাওয়া দু-একটি নারিকেল বা তালগাছের দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু গত সাত-আট বছর ধরে ঝড়ের মৌসুমে বাজ পড়ে মানুষের প্রাণহানিটা যেন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, দেশে বজ্রপাত এবং এর দরুন প্রাণহানি ও ক্ষয়তির মাত্রা দিন দিনই বাড়ছে। কিন্তু এতদিন এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথাও লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়া এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রাণহানির সংবাদ সংগ্রহ করার মাধ্যমেই তাদের দায়িত্ব সারছিল। বজ্রপাত বাড়ার কারণ জানা বা প্রতিরোধের উপায় বের করার বিষয়ে কোনো গবেষণা তো নেই-ই কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের, এমনকি বজ্রপাতে প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উপায় নিয়ে চিন্তাও ছিল এতদিন অনুপস্থিত।

২০০৮ সাল থেকে পর পর কয়েক বছর বজ্রপাত নিয়ে লিখেছি জাতীয় দৈনিকে। প্রতিবারই লেখার আগে কথা বলেছি আবহাওয়া অধিদপ্তর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো (বর্তমানে অধিদপ্তর), বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো), সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের (এসএমআরসি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সবাই একই কথা জানিয়েছেন, বজ্রপাত নিয়ে কোনো গবেষণা নেই তাদের। এমনকি বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে মানতেও রাজি হননি তখনকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর কর্মকর্তারা। ব্যুরোর তখনকার কমিউনিকেশনস ও মিডিয়া স্পেশালিস্ট সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, বজ্রপাত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটি দুর্যোগের সাইড ইফেক্ট (পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) মাত্র। এ অবস্থায় ২০১২ সালে একটি লেখার শিরোনামই দিয়েছিলাম ‘আর কত প্রাণ গেলে তারে দুর্যোগ বলা যায়’ (https://chandan64kalantor.wordpress.com/2012/08/11/)।

অবশেষে ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে পড্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। যদিও সেই পর কয়েক লাখ তালগাছ রোপণ আর কিছু তথ্য প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সব কার্যক্রম।
বাংলাদেশে বজ্রপাত নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও উন্নত বিশ্বে এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে বিস্তর। এসব গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বায়ুদূষণের সঙ্গে বজ্রপাতের নিবিড় সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, বজ্রপাত একদিকে যেমন বাতাসে দূষণের মাত্রা বাড়াচ্ছে, তেমনি আবার বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে বজ্রপাতের হার ও তীব্রতা। এ যেন দূষণের এক নয়া দুষ্টচক্র।
টেক্সাসের অ্যাঅ্যান্ডএম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী নাসার কারিগরি সহায়তায় উপগ্রহের সাহায্যে গবেষণা চালিয়ে দেখতে পেয়েছেন, বজ্রপাতের পরপরই ট্রপসফিয়ারে (বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তর) প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন অক্সাইড (নাইট্রিক অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড) তৈরি হয়। কার্বনডাই-অক্সাইড বা কার্বন মনোক্সাইডের চেয়েও বিষাক্ত এ নাইট্রোজেন অক্সাইড রূপান্তরিত হয়ে যায় ওজোন গ্যাসে। সেই গ্যাস বাতাসের এমন একটি স্তরে জমে থাকছে যে, এর ফলে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এ বিজ্ঞানীদল তাদের গবেষণাপত্রে বলেছে, ‘বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট দূষিত অক্সাইড পরিবেশ দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। যানবাহনের কারণে দূষণ বা শিল্পগুদূষণের চেয়ে বজ্রপাতজনিত দূষণের মাত্রা অনেক বেশি।’ ওই গবেষক দলের প্রধান ড. রেনি ঝাংয়ের মতে, ‘বজ্রপাত যেমন বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়াচ্ছে, তেমনি আবার দূষণের ফলে বাড়ছে বজ্রপাতের হার।’ তবে কেন এমন হচ্ছে তা জানতে আরো গবেষণা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
একই বিষয়ে গবেষণা করেছেন মার্কিন বিজ্ঞানী এনএম টমসন ও তার সঙ্গীরা। বেলুন উড়িয়ে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তারা। ঘন ঘন বৃষ্টিতেও মেক্সিকো সিটির বায়ুদূষণ কেন কমছে না তা পরীক্ষা করে টমসন বলেছেন, ‘বৃষ্টির পানি বায়ুমণ্ডলের দূষিত পদার্থকে ধুয়ে দিচ্ছে ঠিকই; কিন্তু প্রতিবার বাজ পড়ার পরই বাতাসে দূষণ বহুগুণ বেড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। কারণ মেঘের ঘর্ষণে বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন অক্সাইড তৈরি হচ্ছে। সেটা ওজোনে রূপান্তরিত হয়েই সমস্যার সৃষ্টি করছে।’
নাসার মার্শাল স্পেস ফাইট সেন্টারে বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানী উইলিয়াম কোশাক। তিনিও বলেছেন, ‘বজ্রপাত হচ্ছে ট্রপসফিয়ারের উপরিস্তরে নাইট্রোজেন অক্সাইড তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। আর এ অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ওজোন ও হাইড্রক্সিলের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখায় আমাদের জলবায়ুকেও অনেকাংশে প্রভাবিত করে।’
বজ্রপাতের সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে ওজোন গ্যাসের পরিমাণ বাড়ার সম্পর্কের বিষয়টি ধরা পড়েছে নাসার সাহায্যপুষ্ট আরো কয়েকটি গবেষণায়। ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক রিসার্চের (এনসিএআর) বিজ্ঞানী ডেভিড এডওয়ার্ডস ও তার সঙ্গীরা কানাডা এবং ইউরোপের কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে দেখতে পেয়েছেন, বায়ুস্তরের কাছাকাছি যেখানেই ওজোনের পরিমাণ বেশি, সেখানেই বজ্রপাত হয়েছে বেশি মাত্রায়। নাসার বিশেষ মহাকাশযানে চেপে এ সমীা চালানোর পর এডওয়ার্ডস তার গবেষণাপত্রে বলেছেন, ‘দাবানলে যে পরিমাণ ওজোন তৈরি হয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি তৈরি হয় বজ্রপাতে। বায়ুমণ্ডলের নিচের স্তরে ওজোনের পরিমাণ বাড়ার জন্য মূলত বজ্রপাতই দায়ী।’ বজ্রপাত ও বায়ুদূষণের এ দুষ্টচক্র কীভাবে ভাঙা যায় সেটাও অবশ্য খতিয়ে দেখছে নাসা।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক টমাস ডব্লিউ স্মিডলিন তার এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, ঝড়, বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টিতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে বাংলাদেশে। বজ্রাঘাতে বছরে দেড়শর মতো লোকের প্রাণহানির খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও স্মিডলিনের মতে, প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা ৫০০ থেকে এক হাজার। এ দেশে বজ্রপাত বেশি হয় মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময়ে। এ সময় প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাজ পড়ে ৪০টি। ২০০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে একটি বাড়িতে বজ্রাঘাতে ৯ জন নিহত এবং ২৩ জন আহত হওয়ার তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে স্মিডলিনের গবেষণাপত্রে।
২০১২ সালের ১০ আগস্ট সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার একটি অস্থায়ী মসজিদে তারাবির নামাজের সময় বজ্রাঘাতে ঘটনাস্থলেই ইমামসহ ১৩ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও ১৭ জন। রাত ৯টার দিকে উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের সরস্বতীপুর গ্রামে ওই ঘটনা ঘটে। সে বছর শুধু এপ্রিল মাসেই দেশে ১০০ লোক মারা গেছে বজ্রাঘাতে। ১১ মে ২০১২ তারিখে বার্তা সংস্থা ইউএনবি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। মে মাসের শুরু থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত দেশে ২৯ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে ইউএনবি। সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের (এসএমআরসি) বিজ্ঞানী এম আবদুল মান্নান ইউএনবিকে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রাঘাতে মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা রয়েছে। জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় সে বছর ২৪ মে রাতে বজ্রাঘাতে তিন দিনমজুর নিহত এবং একজন গৃহবধূ আহত হযন। ওই সময় মালপত্রসহ দুটি বসতঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে ২৬ মে কালের কণ্ঠ জানায়, রাত ৮টার দিকে সরিষাবাড়ী উপজেলার সাতপোয়া ইউনিয়নের ছাতারিয়া পূর্বপাড়া, ভাটারা ইউনিয়নের চৌখা ও মহাদান ইউনিয়নের কড়গ্রামে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বজ্রের আঘাতে ছাতারিয়া পূর্বপাড়া গ্রামের আবদুল হামিদের বাড়ির দিনমজুর নবীন, মোহাম্মদ ও ময়নাল নিহত হন। ওই সময় তাঁরা ধানেেতর পাশের ঘরে ছিলেন। বজ্রপাতে ঘরটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। একই বছর ৮ এপ্রিল এক দিনেই বজ্রাঘাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাত জনের মৃত্যুর খবর পরদিন ৯ এপ্রিল প্রকাশিত হয় কালের কণ্ঠে। ওই দিন আহত হয় আরো ৯ জন। পত্রিকার ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিতে দুজন এবং বিয়ানীবাজার উপজেলার উলুউরি নয়াপাড়া গ্রামে একজনের মৃত্যু হয়। এ দুই ঘটনায় আহত হয়েছে ৯ জন। এছাড়া চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নারায়ণহাট ইউনিয়নের চানপুর গ্রামে একজন বজ্রাঘাতে মারা গেছে। অন্যদিকে দিনাজপুর, বাগেরহাট ও কুমিল্লায় ওই দিন বজ্রাঘাতে তিনজন নিহত হয়েছে।
২০১১ সালের ২৩ মে বজ্রপাতে বাংলাদেশের ১৮টি জেলায় ৩৫ জনের মৃত্যু ঘটে। আহত হয় অর্ধশতাধিক লোক। প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবর অনুযায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, নাটোর, নোয়াখালী, পাবনা, মানিকগঞ্জ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, চাঁদপুর, মাগুরা, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, খুলনা, কুমিল্লা, ভোলা, গোপালগঞ্জ ও খাগড়াছড়ি জেলায় এসব প্রাণহানি ঘটে। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়ই মারা যায় ৯ জন। চারজন মারা যায় রাজশাহীতে। এর আগের দিন ভোলায় বজ্রাঘাতে মারা যান দুই কৃষক। ‘সাতজন মারা গেল বজ্রাঘাতে’ শিরোনামে সে বছর ২৩ মে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, মেহেরপুর, নেত্রকোনা, নরসিংদী ও চাঁদপুর ও রূপগঞ্জে (নারায়নগঞ্জ) বজ্রাঘাতে স্কুলছাত্রী, গৃহবধূসহ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। ‘বজ্রাঘাতে জামালপুরে বাবা-মেয়ে, জয়পুরহাটে কৃষকের মৃত্যু’ শিরোনামে একই পত্রিকায় ২০১১ সালের ২২ মে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার বগারচর নামাপাড়া গ্রামে শনিবার (২১ মে) সকালে বজ্রপাতে বাবা ও মেয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন বাবা হাসমত আলী (৫৫) ও মেয়ে ফুলেছা (২০)। এ সময় হাসমত আলীর অন্য মেয়ে রমেছা (১৮) গুরুতর আহত হয়েছেন। টিনের ঘরের চালের ওপর বজ্রপাত ঘটে। বজ্রপাতে ঘরের ভেতর থাকা হাসমত আলী ও ফুলেছা মারা যান। একই দিনে বজ্রপাতে জয়পুরহাটের তেলাল উপজেলার উত্তর মহেশপুর গ্রামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। উত্তর মহেশপুর গ্রামের আবু বক্করের ছেলে কৃষক নুর মোহাম্মদ (৩৫) স্থানীয় শালুকডুবি বিলে ধান দেখতে নিজের জমিতে গেলে সকাল সাড়ে ৭টায় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত অপর এক খবরে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৬ মে কিশোরগঞ্জে একই সময়ে ছয় ব্যক্তির প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বজ্রপাত। আহত হয়েছেন আরো অন্তত চারজন। ওইদিন সকালে কিশোরগঞ্জের নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলার হাওরে দুটি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার ব্যক্তিরা হলেন নিকলীর পাড়া বাজিতপুর গ্রামের শুকলাল দাস (২৮), পূর্বগ্রাম বাজারহাটির মানিক মিয়া (৩৮), শামসু মিয়া (৫০) ও রাসেল মিয়া (১৬) এবং বাজিতপুরের হিলচিয়া নোয়াগাঁওয়ের ইসহাক মিয়া (৬০) ও ইব্রাহিম মিয়া (৬০)। গুরুতর আহত নোয়াগাঁওয়ের কফিলউদ্দিন, ফজর আলী, কালাচান মিয়া ও নিকলীর পূর্বগ্রামের জামান মিয়াকে জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ২০০৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ী গ্রামে বজ্রপাতে এক পরিবারের পাঁচ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর আগে ৩ জুন ভোলায় মারা যায় তিন জন। একই বছর ৯ অক্টোবর চট্টগ্রামে বাজ পড়ে এক তরুণ ও এক শিশু মারা যায়। ১৮ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলায় এক জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ২২ আগস্ট ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় এক জন, ২৯ মে মাগুরার শালিখা উপজেলায় এক গৃহবধূ এবং ৩১ মার্চ ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক প্রবাসীসহ দু’জন মারা যায় বজ্রপাতে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মতিননগরে ২০০৮ সালের ৩ জুন বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে কাঁচাঘরে অবস্থানরত একটি পরিবারের চারজন সদস্য মারা যান। এ ঘটনায় ওই পরিবারের আরো চার সদস্য আহত হন। পরদিন ৪ জুন রাতে নীলফামারী সদর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলায় বজ্রপাতে মারা যান পাঁচজন। আরো পাঁচজন হন আহত। একই রাতে বাগেরহাট ও জামালপুরে মারা যান আরো দু’জন।
এর আগে ১৮ মে রাতে ফেনী শহরতলির পশ্চিম বিজয়সিং গ্রামে বজ্রপাতে একটি ঘরে এক মহিলা নিহত এবং শিশুসহ তিনজন আহত হন। এছাড়া বজ্রপাতে সৃষ্ট আগুনে গ্রামের সাতটি বসতঘরসহ ১৪টি ঘর পুড়ে যায়। এর কয়েকদিন পর ২৪ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, মেহেরপুর, নাটোর, পাবনা, বাগেরহাট, নড়াইল ও নেত্রকানা– এ আট জেলায় বজ্রাঘাতে ১৭ জন নিহত এবং ১২ জন আহত হন। দেশে বজ্রাঘাতে একদিনে প্রাণহানির সংখ্যা এটি সর্বোচ্চ।
বার্তা সংস্থা বাসস ও ইউএনবির খবরে জানা যায়, ওই বছর ২৭ মে বজ্রাঘাতে কুমিল্লায় এক পরিবারের দু’জনের মৃত্যুসহ পাঁচ জেলায় ১১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এদিনের ঘটনায় আহত হন আরো ছয়জন।
বিভিন্ন বার্তা সংস্থা ও পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সে বছর ১৮ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ১৮ দিনে দেশের নানা স্থানে বজ্রপাতে ৫১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর আগে ২০ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১৬ দিনে দেশে বজ্রপাতে ২১ জনের মৃত্যুর খবর জানা যায়। এ হিসাবে ৩৩ দিনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫। দেশে ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাতের ঘটনা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস নাগাদ চলে। ওই বছর ৪ অক্টোবর কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার একটি হাওরে বাজ পড়ে দু’জন মারা যায়।
২০০৭ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আড়াই মাসে বজ্রপাতে দেশে ৩৫ জনের মৃত্যুর হিসাব পাওয়া যায়। ওই বছরের ১৫-১৬ জুলাই দু’দিনে দেশে বজ্রপাতে ১৭ জনের প্রাণহানির খবর পাকিস্তান টাইমস পত্রিকার ওয়েবসাইটেও প্রচারিত হয়েছিল। সে তুলনায়ও ২০০৮ সালে দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়তির দিকে ছিল।
২০০৪ সালের ২২ জুন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক নিউজে এক নিবন্ধে বজ্রপাতকে আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক (Second largest weather related killer) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলেই গণ্য করতে রাজি নয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর কমিউনিকেশনস ও মিডিয়া স্পেশালিস্ট সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বজ্রপাত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটি দুর্যোগের সাইড ইফেক্ট (পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) মাত্র। তিনি জানান, বজ্রপাত নিয়ে কোনো গবেষণা ব্যুরোর নেই। তবে ব্যুরোর প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। বজ্রপাতে প্রাণহানির খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা তারা সংগ্রহ করেন। কোথাও প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি বেশি হলে ব্যুরোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে রিপোর্ট দেওয়া হয়। আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে যে ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষদের পক্ষে তেমনটি নেওয়া কঠিন।’
স্পারসোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, বজ্রপাত নিয়ে কোনো গবেষণা নেই তাদেরও।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. শহীদুল ইসলাম জানান, বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়াই তাদের কাজ। এছাড়া বজ্রপাতে মৃত্যুর খবর পত্রিকায় বেরুলে সেটি তারা সংগ্রহ করেন। এর বাইরে এ নিয়ে কোনো গবেষণা বা কাজ অধিদপ্তরের নেই।
সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের (এসএমআরসি) সহকারী গবেষণা কর্মকর্তা আবুবকর আবদুল্লাহর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। পরে একজন বিজ্ঞানী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বজ্রপাত সংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহের একটি প্রকল্প আছে এসএমআরসির। এর বেশি কিছু বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।
বজ্রপাতে যারা মারা যায় তাদের প্রায় সবাই গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। সে কারণেই হয়তোবা মাথাব্যথা নেই আমাদের দেশের গবেষকদের।
বিশ্বজুড়েই বজ্রপাতে প্রাণহানি বাড়ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর দিনাজপুরে গত ১১ মে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয় ১০ জনের। আহত হয় আরো ১০ জন। ওই দিনই স্টার আনন্দ নিউজ বুলেটিনে বলা হয়, আহতদের ভর্তি করা হয়েছে রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে। কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন ৩ মহিলা ও ১ শিশু।টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, ২০১০ সালের ৪ অক্টোবর ভারতের মহরাষ্ট্র রাজ্যের নাগপুর অঞ্চলের কয়েকটি এলাকায় বজ্রাঘাতে ২৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয় আরো ২৭ জন। আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, ২০০৭ সালের মার্চ থেকে মধ্য আগস্ট পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে বজ্রাঘাতে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবেই ৮২। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর অনুযায়ী ২০০৬ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে ভারতের কেবল উড়িষ্যাতেই ৩০ জনের মৃত্যু ঘটে বজ্রাঘাতে। একই অবস্থা ইউরোপ-আমেরিকায়ও। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে ৭৫ থেকে ১০০ জনের মৃত্যু ঘটে বজ্রাঘাতে। ২০০৩ সালে সে দেশে বজ্রাঘাতে মারা যায় পাঁচশ’র বেশি মানুষ। আমাদের দেশে সাধারণত গরিব মানুষ বজ্রপাতের শিকার হলেও ইউরোপ-আমেরিকায় নভোচারীরাও রেহাই পাচ্ছেন না এ প্রাকৃতিক ঘাতকের হাত থেকে। বজ্রপাতের হাত থেকে মহাকাশযান ও নভোচারীদের রা করতে তাই এক বিরাট প্রকল্প হাতে নিয়েছে নাসা।

About

AZADUR RAHMAN CHANDAN E-mail : archandan64@gmail.com Date of Birth : November 27, 1964 Profession : Journalist (Working at The Daily Kaler Kantho) Academic Qualification : BScAg (Hons) from Bangladesh Agricultural University Institute : Patuakhali Agricultural College

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *